প্রকাশিত: ১০/০৩/২০১৮ ৭:৫০ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:৩৯ এএম

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার::
দেশজুড়ে বাড়ছে মরণ নেশা ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন। মাদকসেবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যবসায়ীর সংখ্যাও। অধিক মুনাফার লোভে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই এক সময় ছিল হতদরিদ্র। মাদক ব্যবসার কারণে তারা এখন কোটিপতি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ সদস্যের নামও আছে ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায়। এদের আত্মীয়স্বজনসহ অনেকেই ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসায়ি ও জনপ্রতিনিধির তমকা লাগানোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এদের ভয়ে তটস্থ থাকে। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে নির্বিঘেœ ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এসব ইয়াবা গডফাদাররা। এধরনের ইয়াবা ব্যবসা প্রকাশ্যে করে যাচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের দশঘর পাড়া (সাবেক বডডেইল) গ্রামের ৪ সহোদর। চার সহোদরের মুল গড ফাদার সিরাজুল ইসলাম ছিকুইন্না। এই চিকুইন্নার বাড়ি মিয়ানমারের কুয়ানচি বন লারগোয়া পাড়ার বাসিন্দা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প, পালংখালির আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে অবস্থান নেয়। পরে কক্সবাজার, চট্টগ্রামে বিলাস বহুল বাড়ি নির্মাণ করে ইয়াবা ব্যবসা অব্যাহত রাখে। চিকুইন্না সিন্ডিকেটের মধ্যে এক ভাই নামে হাজী হলেও এখন ইয়াবা গডফাদার হিসেবে তালিকায় নাম উঠেছে। এই গডফাদার মুফিজুর রহমানকে অনেকে হাজী মুফিজ আবার কেউ ইয়াবা মুফিজ হিসেবে চিনে এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত আবুল মনজুর। গত কয়েক বছর ধরে ইয়াবার ব্যবসা করেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ১২২৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী তালিকায়ও তার নাম রয়েছে বলে সুত্রে প্রকাশ। ইতোপূর্বে ইয়াবার বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে থাকে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে এলাকা থেকে বেশ কিছুদিন গা ডাকা দেয় মুফিজ।

এলাকাবাসি সুত্রে জানা যায়, গত ১০/১৫ বছর আগে দারিদ্রতার জন্য ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যান মুফিজ। সেখানে কয়েক বছর অবস্থান করার পর নানান কৌশলে পালিয়ে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তানে গিয়ে আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদি গ্রুপের সাথে যুক্ত হন। ট্রেনিং নেন জঙ্গী তৎপরতার। কৌশলে পাকিস্তান থেকে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সৌদি আরবেও বেশ কয়েক বছর অবস্থান করার পর কিছু অর্থ কড়ি নিয়ে চলে আসেন দেশে। এখানে এসে শুরু করেন মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট ব্যবসা। এখানে তার উত্তান। তাকে আর পেছন ফিরে থাকা হয়নি। কোটি কোটি টাকার ইয়াবার চালান পাচার করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। ইয়াবার বিরুদ্ধে আইনশৃঙঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার ও ইয়াবা ব্যবসায়িদের গ্রেফতার অভিযান চললে সেই সময় আত্মগোপনে চলে যান হাজী মুফিজ। তবে আত্মগোপনে থাকলেও একমুহুর্তের জন্য থেমে থাকেনি ইয়াবা ব্যবসা। অধিক মুনাফার লোভে এ ব্যবসায় জড়ান তার আপন আরো ৩ সহোদরকে।

সুত্রে আরো জানা যায়, গত কিছুদিন ইয়াবার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কিছুটা ভাটা পড়ায় এই মুফিজ, তার আরো ৩ সহোদর আজিজুর রহমান বাবুল, মুজিবুর রহমান কানা মুইন্না , আনোয়ারুল ইসলাম প্রকাশ সোনা মিয়া ও তার সহযোগীরা ফের সক্রিয় হয়ে বড়ো বড়ো ইয়াবা চালান পাচার করছে। তারা দেদারছে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা ও বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে সারা দেশে ইয়াবা পাচার করে তারা। ফলে বার বারই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পালংখালী এলাকাবাসী এই চার সহোদরকে চিহ্নিত ইয়াবা গড ফাদার হিসেবে চিনেন। পুলিশের খাতায় ইয়াবা ব্যবসায়ি হিসেবে নামও রয়েছে তাদের। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের টাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালায় ইয়াবা ব্যবসা। ফলে তারা অঁধরাই রয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের কিছুর নেতার ছত্রছায়ায় থেকে দিনের পর দিন ইয়াবা ব্যবসা অপ্রতিরোধ্য ভাবে চালিয়ে আসছে। আর ইয়াবার ব্যবসা করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গেড়েছে। এরা আগে অত্যন্ত গরীব ছিল। দিনে এনে দিনে খেত। যাদের সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরাত, বাড়ি ছিল ছনের তৈরী। মুফিজের ছোট ভাই আনোয়ার ছিল একজন দর্জি। আজিজুর রহমান বাবুল ছিল বেকার। তার আরেক ভাই মুজিব ছিল পালংখালী ইউনিয়নের চিহ্নিত ডাকাত। তাদের দৈনিক দেড় ২’শ টাকা আয় করতেও কষ্ট হত।

লাল বড়ির আদলে তারা প্রত্যেকটি ভাই আজ কোটিপতি। হাজী মুফিজের ভাই আজিজুর রহমান বাবুল ইয়াবা ব্যবসা করে কয়েক কোটি টাকার মালিক। যার ছিল না, ১ শ টাকা ব্যয় করার সামর্থ। সে আজ লাখ লাখ টাকার কসমেটিকস দোকান মালিক ও কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক এবং নগদ লাখ লাখ টাকার মালিক। এক সময় এই আজিজুর রহমান বাবুল ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) এর হাতে আটক হয়েছিল। ৬ মাস কারাভোগ করে আজিজ। পরে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়। তার ভাই মুজিবুর রহমান ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত। তার ভয়ে সব সময় তটস্ত থাকতো এলাকাবাসি। মুজিবুর রহমান ও তার দলের সাথে পুলিশ গুলিবিনিময় ঘটে। ক্রস ফায়ারে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় তাকে। গত ২০০৯ ক্রসফায়ারে গ্রেফতার হওয়ার পর দীর্ঘদিন কারা ভোগ করে ২০১৩ সালে জামিনে বেরিয়ে আসেন। জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় শুরু করে ইয়াবা ব্যবসা। সেও আজ কোটিপতি।

তার আরেক ভাই আনোয়ারুল ইসলাম। একসময় দর্জির কাজ করতো। দিনে ২’শ টাকা আয় করতে যিনি হিমশিম খেত, সে আজ ইয়াবার জোরে কোটিপতি। এই আনোয়ারুল ইসলাম কয়েক বছরের ব্যবধানে একটি নোয়া গাড়ি, একটি সিএনজি, পালংখালী বাজারে মা ইলেকট্রনিক্স নামের একটি দোকান দিয়েছে, নিজে ব্যবহারের জন্য দু’টি মোটর সাইকেল কিনেছে এছাড়াও ক্রয় করেছে লাখ লাখ টাকা ভু-সম্পত্তি। এই চার ভাই সিন্ডিকেট বিভিন্ন যানবাহনের বডির সাথে সঙযুক্ত করে বিশেষ কায়দায় পুরো ইয়াবা সাপ্লাই দেন ঢাকার টঙ্গি স্টেশন রোডের রেজাউল করিম, রামপুরা বাড্ডার বাবলু ও নোয়াখালী জমিদারহাটের মাহফুজ (সাবেক এসএ পরিবহণ কর্মচারী) কে।

কক্সবাজারেও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অল্প সময়ে কোটিপতি হতেই ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায় জড়ান প্রভাবশালীরা। এখন তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি দলীয় প্রভাব খাটিয়েও মাদক ব্যবসা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বদলির ভয় থাকে। তাই ইচ্ছা থাকলেও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।’

সচেতন মহল মনে করেন, তারা যদি প্রকাশ্যে এভাবে ইয়াবা ব্যবসা কর্ েথাকে। তাহলে সমগ্র বাংলাদেশের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। অস্বাভাবিক ভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই ৪ সহোদর ইয়াবা ব্যবসায়ির সম্পদ তদন্ত করা দরকার। আইনশৃ্খংলা রক্ষাকারী বাহিনী ও উর্ধ্বতন প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরী বলে মনে করেন স্থানীয় এলাকাবাসি।

মুজিবুর রহমান, আজিজুর রহমানের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, মুজিব ইয়াবা ব্যবসা করে না। দোকান নিয়ে ভাইয়ের সাথে ব্যবসা করেন এবং বাড়ি ঘর নিয়ে আছেন।

আজিজুর রহমান বলেন, আমি চাষের কাজ করি এবং কাঠের ব্যবসা করি। ইয়াবায় জড়িত নয়। তবে ঢাকায় ডিবি হাতে ইয়াবার চালান নিয়ে আটক হওয়ার কথা তুললেই তিনি পরে কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাদের ভাই আনোয়ারও জানালেন একই কথা। বৈদ্যুতিক মালামালের দোকান দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছে। এব্যাপারে হাজি গডফাদার খ্যাত মুফিজুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বিগত মহাজোট সরকারের আমল থেকে এ অঞ্চলে মাদক ব্যবসার রমরমা অবস্থা চলছে। দিন যত যাচ্ছে মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাই শুধু বাড়ছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা তেমন কোনো কথা বলতে চাননি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ কারণে তারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে পারছেন না। ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো নিজেকে হয়রানির মুখে পড়তে হয়। তারা ঝামেলায় যেতে চান না।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল খায়ের এর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, উখিয়া থানায় ১৪-১৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। এতবড় এলাকা পাহারা দেয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তারা ইয়াবা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তালিকাভুক্ত অনেকেই এখন অভিযানের কারণে এলাকা ছাড়া বলেও দাবী করেন তিনি।

পাঠকের মতামত